অনুপম মুখোপাধ্যায়



।।কিছুদিন আগে আরাকু গিয়েছিলাম। বাঙালি ভরপুর। আর অসংখ্য ক্লিকের শব্দ। কেউ কিছু দেখছে না। সবকিছু ক্যামেরায় তুলে রাখছে। পরে কি সত্যিই দেখবে? নাকি বুড়ো বয়সের জন্য তুলে রাখছে? কৈলাস গিরির উপরে উঠে একটা পাথরে বসে সামনে বিপুল সমুদ্রে আর চারপাশের বিষণ্ণ পাথুরে উদ্ভিদগুলো দেখে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম। বুকের ভিতর থেকে উপচে আসছিল এক অসম্ভব দুঃখবোধ। কিন্তু আবার একদল বাঙালি হাজির হয়ে গেল ‘ছোবি’ তোলার জন্যএরা মনে হয় ঈশ্বরের দেখা পেলেও তাঁর বর চাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে চাইবে। সত্যি, সেলফি আর তো কাউকেই সেলফিশ রাখছে না। নিজের সবটুকু খুল্লাম খুল্লা করিয়ে ছাড়ছে।
বাঙালি নিজের প্রাইভেট লাইফ আর সোশ্যাল লাইফ ঘেঁটে ঘ করে ফেলেছে। সবাই এখন এক সেকেন্ডের রেমব্রাঁ, দেড় সেকেন্ডের ভ্যান ঘগ। লোকে এখন সাগরে নিজেকে চোবায় দুরন্ত সেলফি তুলবে বলে। পাহাড়ে নিজেকে চড়ায় দুর্দ্ধর্ষ সেলফি তুলবে বলে। দামি রেস্তোঁরায় নিজেকে টেনে যায় দুর্দান্ত সেলফি তুলবে বলে। আশা করি খুব শিগগির কেউ কেউ ফুলশয্যার চরম মুহূর্তটিও স্বচ্ছ সেলফিতে উপহার দেবেন আমাদের। ওটার জন্যই হয়ত বিয়ে করবেন কেউ কেউ। কিংবা প্রিয়জনের মুখাগ্নি করার আগে এক হাতে আগুন রেখে একটু ঘাড় বাঁকিয়ে আরেক হাতে তুলে নেবেন নিজের মুখটা। ঠিক ওই মুহূর্তগুলোতে স্মার্টফোন বিগড়ে গেলে, হাত থেকে খসে গেলে, বা মেমরি ফেল করলেই লাইফ কেরোসিন
আর কবিতা? এই সময়ের কবিতা? সময় কবিতাকে প্রাসঙ্গিক করে না, কবিতাই সময়কে প্রাসঙ্গিকতা দ্যায়। যে সময়ের নিজস্ব কবিতা নেই, সে বড় দরিদ্র সময়। ২০০০ পরবর্তী অগণিত কবিকে দেখে আজ মনে হয় তাঁরাও ঠিক ওভাবেই সেলফি তোলার মানসিকতা নিয়ে কবিতা লিখতে এসেছেন। সেলফিবাজদের কাছে যেমন দেখার চেয়ে দেখানোটা জরুরি, এই কবিদেরও লেখার চেয়ে ছাপাটাই জরুরি। শূন্য দশকের বেশ কিছু নামকরা নামের ক্ষেত্রেও এটাই সত্যিই। হয়ত ভাবা গিয়েছিল এক সময় এঁরা সত্যিই নিজের কবিতা লিখবেন, সেটা হল না। কেউ আশির দশকের কবিতার সংক্ষিপ্তসার বানিয়ে ফেললেন নিজেকে, জ্ঞানের ভান করতে করতে শুধু বলার অভিনয় করে গেলেন, আর এমন সব হাততালি কুড়োলেন, যেখানে হাত আছে কিছু আঙুলগুলো উধাও। কেউ শুরু করলেন পঞ্চাশের দশকের কবিতাচর্চা, কেউ সত্তরের। কেউ আবার স্রেফ ‘আহা রক্ত এসো যোনি/ মা মা করছে থালা’-র খেলায় এমন মাতলেন, নিজের একটাও কবিতা লিখলেন না, শুধু একটাই চেষ্টা অসংখ্য কাগজে করে গেলেন, আর বন্ধু বাড়িয়ে গেলেন। শূন্য দশক কবিবন্ধু শব্দটাকে যেখানে নিয়ে গেছে, সেখান থেকে তার বেশি অবিশ্বাসজনক ওই শব্দটি আর হয়ত হবে না। এটা হওয়ার কথা ছিল না।
আর এর মধ্যে খবর পেলাম কবি অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থ। ২০০০ পরবর্তী পরিসরে যে অতি অল্প কয়েকটি নাম উজ্জ্বল হয়েছে, কাজ করেছে সত্যিই, তাদের মধ্যে অর্জুন একজন। ওর অসুস্থতা এই কালখন্ডটিকে রুগ্ন করছে। সুস্থ হোক ও।
সত্যিই ভাবি, অল্প কয়েকটা নাম বাদ দিলে ২০০০ পরবর্তী কবিতা শুধু সম্ভাবনায় কেন রয়ে গেল? শুধু কেন অগ্রজদের দাসানুদাস হয়ে রয়ে গেল? শ্রমবিমুখতা? কেন শুধু পুনরাবৃত্তি করে গেল? অভ্যাস? কেন অসংখ্য সম্ভাবনাময় কবি শেষ অবধি রিস্ক নিলেন না, বদতমিজ হলেন না? আর সেটা হতে গিয়েও টকটকে লাল রঙের ঋত্বিকতন্ত্র বা অকারণ অসভ্যতার দিকে চলে গেলেন? পঞ্চাশের দশক বাংলা কবিতায় একটা বিষ ইঞ্জেক্ট করেছিল- সেটা হল উদ্বাস্তু মানসিকতা। শূন্য দশকের কিছু কবিও সেটা থেকে মুক্ত নন, হতে পারেননি, চাননি। প্রথম দশককে বরং ও ব্যাপারে একটু নির্মল মনে হয়।
ভাল কবিতা লেখা নেশাটা সত্যিই ভাল সেলফি তোলার নেশার চেয়েও ঘাতক হয়ে উঠছে এই সময়ে। এখন আপনি যদি মহাভারতচর্চা করেন, আপনার সমবয়সীরাও সেটা করবে। আপনি পয়ারে লিখলে তারাও লিখবে। আপনি যদি কবিতায় সবুজ কালি ব্যবহার করেন, আপনার সমবয়সীরাও করবে। আপনি যদি লেখেন ‘কুয়াশার মতো নয়’, তাহলে আপনার কবিবন্ধু লিখবে, ‘ধোঁয়াশার মতো নয়’।
যে কোনো স্বাতন্ত্রের মোকাবিলা এখানে করা হয় অনুকরণের মাধ্যমে, অন্য একটা অস্ত্রের সন্ধান করার ঝোঁক খুব কম জনের মধ্যে দেখা যায়। আর যখন একজনের স্বাতন্ত্রকে নিজের লেখায় নিতে না পারে, এখানে সেটাকে সন্দেহের পাল্লায় ফেলে বিচার করা হয়, একমাত্র তখনই শুরু হয় নৈঃশব্দ আর খারিজের খেলা। ভাল কবিতার পাসপোর্ট তখন তার বেঢপ শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, মলাট খোলে, দানবিক মনে হয় তাকে। ফিসফাস শুরু হয়- ‘আরে, ও কবি নয়। ও যেগুলো লেখে সেগুলো কবিতা নয়। কবিতা অমন হয় না।’
ভাই, কবিতা কেমন হয়, আর কবি কাকে বলে, আপনি যদি জানেন, আপনি নিজেই কবি হয়ে লিখুন না একটা কবিতা! আপনি তো নিজেই বহু আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্বীকার করে বসে আছেন আপনি কবি নন, নেহাত যোগাযোগ আর ধারণা ভাঙিয়ে খাচ্ছেন, তাই না?
এখন তো ২০২০ এগিয়ে আসছে। এই শতাব্দীর কবিতা কৈশোরে পৌছচ্ছে। তার মুখে মৃদু রোমরেখা, তার বুকে স্তনের উদ্ভাস। এখনও কি বিগত শতাব্দীর আদর্শেই চলবেন ৪০ অনূর্দ্ধ কবিরা? আর কবে লিখবেন আপনারা ২০৫০-এর পাঠকের জন্য? খারাপ কবিতার পিপাসা জেগেছে এবার খুব, তাই...
‘বাক্’ এবার শুধু খারাপ কবিতা ছাপতে চায়। হরিণের মতো খারাপ। খরগোশের মতো খারাপ। সারসের মতো খারাপ। এমন কবিতা চায়, যেখানে কোনো ঢেকুরের শব্দ নেই, আছে এক তৃষ্ণার্ত প্রাণীর নদীজলে মুখ ডুবিয়ে জল খাওয়ার আওয়াজ। একটা অন্য উচ্চারণের জন্য, প্রয়োজন হলে, বাংলা কবিতার যে কোনো প্রতিষ্ঠিত নামকে সূচিপত্র থেকে বাদ দেওয়ার জন্য ‘বাক্’ তৈরি রয়েছে এখন।

9 comments:

  1. জ্বালাময় সম্পাদকীয়... খারাপ কবিতাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য ব্যকুল হচ্ছে মন...

    ReplyDelete
  2. বাক্এর সাহস আছে, মেধা আছে, চাবুকও আছে। ভালো লাগল এই প্রয়াস।

    ReplyDelete
  3. অসামান্য লেখা। বলতে দ্বিধা নেই; নিজের শরীরেও কিছু আঁচ পেলাম ওই চল্লিশ সংখ্যাটির উল্লেখে।

    ReplyDelete
  4. আমরা একটা বেছে নেবার লোক পাচ্ছি।

    ReplyDelete
  5. বাকরুদ্ধ হলাম পড়ে।

    ReplyDelete
  6. বাহ ! কোন ঢেকুরের শব্দ নেই ।

    ReplyDelete
  7. kobitai samoyke prasongikata dyay --lineti ekti sathik , ar sathik bolei bhari sundor uchharon

    ReplyDelete
  8. দেখা যাক

    ReplyDelete
  9. যে সময়ের নিজস্ব কবিতা সে বড় দরিদ্র সময়... ২০০০ শতাব্দীরও আছে। পুনরাধুনিক আছে, শান্তনু বেজ আছেন,আর ঐ যে বেবি অমিতাভ প্রহরাজ আছে... আরো আছেন... একটু আলাদা একটু অন্যস্বাদের বলে এদের নাম নিলাম... আরো আসবে আরো লিখবে

    ReplyDelete